মোবাইল ফোন কিভাবে কাজ করে?
> আমাদের সবার জীবনেই মোবাইল একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আমি এখন শিউর যে আপনাদের কিউরিয়াস মাইন্ডে সবসময় কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরাঘুরি করে যেমনঃ
• কিভাবে মোবাইল ফোনকলগুলো কাজ করে?
• কেন মোবাইল কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জেনারেশন(যেমনঃ ওয়ান-জি,টু-জি,থ্রি-জি,ফোর-জি,ফাইভ-জি ইত্যাদি) রয়েছে?
• কিভাবে মোবাইলের ভিতরে থাকা বিভিন্ন ছোট ছোট যন্ত্রগুলো কাজ করে?
এরকম অনেক প্রশ্ন রয়েছে এই মোবাইল কমিউনিকেশনের টেকনোলজি নিয়ে!তাহলে চলুন বেশি কথা না বলেই এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
যখন আমরা ফোনে কথা বলি তখন ব্যাপারটা আসলে কি ঘটে? কখনো চিন্তা করেছেন? এই জিনিসগুলো বেশি বেশি চিন্তা করবেন। চিন্তা করলে কি হবে জানেন? আপনার যে মগজটা আছে সেই মগজটা বেশি উত্তেজিত হতে চেয়ে আগ্রহ প্রকাশ করবে আর এতে জানার আগ্রহ বাড়বে।তাই আগে ভাবতে শিখবেন যতক্ষণ পর্যন্ত উত্তর নিজে না পান ততক্ষণ ভেবে যাবেন। আর যদি নাই পান আর নাহ অনেক কিছুই ভাবলেন কিন্তু অনেক কনফিউজ লাগতেছে আপনার তাহলে আর ভেবে কি লাভ! চলুন দেখি কি ঘটে আসলে।
• প্রথম কাজ, যখন আমরা ফোনে কথা বলি তখন আমাদের কথাগুলো আমাদের ফোনে থাকা মাইক্রোফোন সংগ্রহ করে থাকে। মাইক্রোফোন কি জিনিস এইটা আমরা অনেকেই জানি যারা জানেন না তারা গুগল করে দেখতে পারেন। প্রচুর আর্টিকেল ও ইউটিউবে ভিডিও রয়েছে দেখে নিবেন অবশ্যই।
• তারপর মাইক্রোফোন MEMS Sensor এবং IC এর সাহায্যে আমাদের কথাগুলোকে(এনালগ সিগনাল) একটা ডিজিটাল সিগনালে(0,1) রূপান্তরিত করে থাকে।
• এই ডিজিটাল সিগনাল আমাদের কথাগুলোকে(এনাগল সিগনাল) জিরো এবং ওয়ান এর গঠনমূলক সংখ্যা (বাইনারী সংখ্যা) তৈরী করে থাকে।• এরপর ফোনে থাকে একধরণের এন্টেনা যা বেশিরভাগ ফোনের উপরিভাগ অংশে থাকে। এই এন্টেনাটি সেই জিরো এবং ওয়ানের গঠনমূলক সংখ্যা অর্থাৎ বাইনারী সংখ্যা রিসিভ করে থাকে এবং সেগুলোকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ এ রূপান্তরিত করে থাকে।
• ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বাইনারী সংখ্যাগুলোকে ওয়েভ এর বৈশিষ্ট্যগুলোকে পরিবর্তন করে এমপ্লিটিউড(Amplitude), ফ্রিকোয়েন্সী(Frequency) ,ফ্যাজ(Phase) অথবা এইসবের কম্বিনেশনে রূপান্তর করে।যেমনঃ 101101(Binary ) কে ফ্রিকুয়েন্সিতে পরিবর্তন করে ( High,Low,High,High,Low,High) এ রূপান্তর করে।
তাহলে যখন এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েবগুলোকে আমাদের কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের ফোনের কাছে পাঠানোর সবচেয়ে সহজ একটা রাস্তা পাবো তখনি আমাদের ফোনকল তৈরী হবে।কিন্তু ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভগুলো লম্বা দূরত্বে যেতেই অক্ষম। কারণ কোনো বস্তু, দেয়াল, ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি (যেমন মাইক্রোওভেন, টিভি ইত্যাদি) এবং প্রাকৃতিক বাঁধার কারণে (যেমন বৃষ্টি) এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভগুলোর শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং ফোনকল তৈরী করা যায় না! আবার সেখানে যদি কোনো সমস্যাই না থাকে তবুও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভগুলো বেশিক্ষণ কাজ করবে না এর কারণ হচ্ছে আমরা সবাই জানি পৃথিবীটা উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই বাঁকা আকৃতি মানে অনেকটাই গোলাকার রাস্তা। আশা করি বুঝতে পারছেন। এই সমস্যা দূর করার জন্যেই সেল টাওয়ার ব্যবহার করার হয়। সেল টাওয়ার এক ধরণের সেলুলার টেকনোলজি এর কনসেপ্ট হিসেবে পরিচিত।
এই লাইট পালসগুলো টাওয়ারের নিচে থাকা ট্রান্সিভার বক্সে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল এর মাধ্যমে পরবর্তী সিগনাল প্রসেসিং এর জন্যে বহন করে। প্রসেসিং এর পরে আমাদের কথাগুলোকে(এনালগ সিগন্যাল)পালসের সাহায্যে আমাদের বন্ধু বা আত্মীয়ের ফোনের গন্তব্যে থাকা কোনো টাওয়ারের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। যখন সেই বন্ধু বা আত্মীয়ের ফোনের কোনো সেল টাওয়ারের নিচে থাকা ট্রান্সিভার বক্সের মাধ্যমে আসা লাইট পালসগুলোকে আবার সেই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভে রূপান্তর করে এবং আমাদের সেই বন্ধুর ফোনে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ রিসিভ করে থাকে। আর এই সিগন্যাল রিভার্স প্রসেস করে স্পিকারের মাধ্যমে আমাদের বন্ধু আমাদের কথাগুলো শুনতে পায়।
তাহলে আমরা বলতে পারি যে মোবাইল কমিউনিকেশন পুরোপুরি তারবিহীন না, এগুলোকে একটা তারের মাধ্যমেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এইভাবেই আমাদের মোবাইল কমিউনিকেশনগুলো কাজ করে থাকে।
যাইহোক তারপরেও আমাদের মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের মোবাইল কমিউনিকেশন তখনি কাজ করবে যদি আমাদের টাওয়ার সেই ফোনের কথাগুলোর সিগন্যালকে আমাদের বন্ধুর ফোনের টাওয়ারে ট্রান্সফার করা হয়। কিন্তু আমাদের টাওয়ারগুলো জানবে কিভাবে যে আমাদের বন্ধুটি সেই মূহুর্তে কোন টাওয়ার সেলে অবস্থান করছে? এই সমস্যাটির জন্যে আমাদের টাওয়ারগুলো MSC(Mobile Switching Centre) এর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাকে। এই MSC হচ্ছে কয়েকটা সেল টাওয়ারগুলোর কেন্দ্রের পয়েন্ট।
তাহলে কোন সেল এলাকায় আমরা যখন MSC এর সাথে যুক্ত হই তখন MSC কয়েকটা টেকনিক ব্যবহার করে থাকে সেগুলো হলোঃ
১. Time Based: কয়েক মূহুর্তেই একটা পদ্ধতিতে আমাদের অবস্থান আপডেট করে থাকে।
২. Location Area Based: কয়েকটা টাওয়ার যখন আমরা পার করি তখন শেষ যে টাওয়ারে অবস্থান করি সেই টাওয়ারের অবস্থান আবার আপডেট হয়ে থাকে।
৩. When Phone Turns On: যখন শেষ অবস্থানে আমরা ফোন অন করি তখনি আমাদের অবস্থান আপডেট হয়ে থাকে।
এবার আমরা আবার একটা ছোট উদাহরণের মাধ্যমে পুরো বিষয়টা একবার বুঝে নেই।
ধরি রহিম তার বন্ধু করিমকে ফোন করবে। যখন রহিম করিমের নাম্বার ডায়াল করবে তখন করিমের Home MSC তে একটা ডিসিশন রিকুয়েষ্ট পাঠাবে। আর তখনি Home MSC খুঁজে বের করবে করিমের বর্তমান অবস্থান। যদি করিম তার Home MSC তেই অবস্থান করে তাহলে সেই ডিসিশন রিকুয়েস্ট তার বর্তমান অবস্থানে থাকা অবস্থায় ফোনে পাঠাবে আর তখন এই রিকুয়েষ্টটা দেখবে যে করিম কি অন্য কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে কিনা বা তার মোবাইল অন আছে কিনা। যদি সব পজিটিভ থাকে তাহলে করিমের ফোন বেজে উঠবে এবং ফোনকল কানেক্টেড হবে। আবার যদি করিম তার Home MSC তে অবস্থান না করে তাহলে করিমের Home MSC সাথে সাথে Foreign MSC তে ডিসিশন রিকুয়েস্ট ফরোয়ার্ড করবে। সেই Foreign MSC আমরা আগে যেভাবে MSC এর টেকনিকগুলো আলোচনা করেছি সেভাবে তার অবস্থান আপডেট করবে এবং ডিসিশন রিকুএস্ট চেক করবে।
চলুন আমরা একটা ব্যাপারে আলোচনা করি যে কেন ফ্রিকোয়েন্সি স্পেক্ট্রামটি মোবাইল কমিউনিকেশনের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডাটা কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে জিরো এবং ওয়ান ট্রান্সফার করার জন্যে প্রত্যেক সাবস্ক্রাইবার এর ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ নির্দিষ্ট থাকে। এই ফ্রিকোয়েন্সি স্পেক্ট্রামটি সেলুলার কমিউনিকেশন এর জন্যে খুবই সীমিত থাকে এবং সেখানে বিলিয়ন সংখ্যক সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। এই সমস্যাটি সমাধান করা হয় দুটি পুদ্ধিতিতে।
1. Frequency Slot Distribution
2. Multiple Access Technique.
প্রথম পদ্ধতিতে, বিভিন্ন সেল টাওয়ারগুলোতে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি স্লটগুলো নির্দিষ্ট করা থাকে।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, সেল এরিয়াতে থাকা সকল ফোন ইউজার অর্থাৎ সাবস্ক্রাইবারের মাঝে এই ফ্রিকোয়েন্সি স্লটগুলো খুবই দক্ষতার সাথে বন্টিত করা হয়।
এবার একটা বড় প্রশ্ন, কেন মোবাইল টেকনোলজিগুলোতে বিভিন্ন জেনারেশন(যেমনঃ ওয়ান-জি,টু-জি,থ্রি-জি,ফোর-জি,ফাইভ-জি ইত্যাদি) রয়েছে?
ওয়ান-জি ফোনগুলো সাধারণত ব্যবহার করা হয়ে থাকে কোনো ক্যাবল বা তার ছাড়াই। কিন্তু ওয়ান-জি তে দুটি প্রধান সমস্যা রয়েছে। প্রথম যে সমস্যাটি সেটি হলো তারবিহীন ট্রান্সমিশন একধরণের এনালগ ফরম্যাটে থাকতো। এনালগ সিগন্যালগুলো খুব সহজেই বাইরের সোর্সগুলোতে পরিবর্তন হয়ে যেত। তাই এতে খুবই বাজে ভয়েস কোয়ালিটি এবং বাজে সিকিউরিটি থাকতো। আর দ্বিতীয় যে সমস্যাটি সেটি হলো এটি Frequency Division Multiple Access Techniques ব্যবহার করা হতো। মানে এটিতে অদক্ষভাবে ফ্রিকোয়েন্সি স্পেক্ট্রাম ব্যবহার করা হতো।
এই কারণগুলো বিবেচনা করার পর টু-জি বাজারে এসে যায়। টু-জি তে TDMA(Time Division Multiple Access) অথবা CDMA( Code Division Multiple Access) Technology নামক Digital Multiple Access Technology ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই টু-জি জেনারেশনই রেভলুশনারি ডাটা সার্ভিস, এসএমএস এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিং যুক্ত করে।
থ্রি-জি টেকনোলজি মূলত ফোকাস করেছে খুব দ্রুত ডাটা ট্রান্সফার করার পদ্ধতি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে WCD Multiple Access Technique।
এই থ্রি-জি টেকনোলজিগুলোতে ২ এমবিপিএস পর্যন্ত ব্যবহার করা হতো জিপিএস, ভিডিও, ভয়েস কল ইত্যাদি এর জন্যে। থ্রি-জি টেকনোলজিগুলোই ফোনগুলোকে স্মার্টফোনে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
থ্রি-জি এর পর এসে যায় ফোর-জি টেকনোলজি যেটিতে হাই-স্পিড ডাটা ট্রান্সফার করা। ভিডিও, মুভি এবং টেলিভিশন ও এই ফোর-জি টেকনোলজিগুলোতে ব্যবহার করা যায়। এই হায়ার-স্পিড সক্ষম হয়েছে OFD Multiple Access Technology এবং MIMO Technology এর জন্যে। MIMO মূলত Multiple Transmitters Receiver Antena গুলোকে মোবাইল এবং টাওয়ার উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করে থাকে।
পরের জেনারেশন ফাইভ-জি টেকনোলজি যেটা খুব দ্রুতই এসে যাবে। এতে MIMO Technology এবং Milimitter Waves এর ব্যবহার বাড়ানো হবে। আর এটি দিয়ে বিভিন্ন IOT জিনিস কানেক্ট করতে পারবে। যেমন মোবাইল দিয়ে মাইক্রো ওভেন কাজ করা, ফ্রিজের কাজ, টিভির রিমোটের বদলে কাজ করা, ঘরের ডিজিটাল ফ্যান-লাইটের সুইচ হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি।
যদি আমার লেখাগুলোতে কোনো ভুল ইনফোরমেশন পেয়ে থাকেন তাহলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং কমেন্ট করে জানাবেন। আমি ঠিক করে দিবো। 😀
Comments
Post a Comment